অন্ধকারের চিত্রমালা

অন্ধকারের চিত্রমালা

-শুভদীপ রায়

(নেপোলিয়নীয় যুদ্ধপরবর্তী স্পেনের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, ১৯১৯-১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে চিত্রকর ফ্রান্সিস্কো গোয়ার তুলিতে ধরা দেয় মানুষের গোপন লালসা, অসহায়তা, নিষ্ঠুরতা ও বিপর্যয়ের নানা আঙ্গিক। "ব্ল্যাক পেইন্টিংস্" নামে বিখ্যাত যথাক্রমে “স্যাটার্নো দেভরান্ড আ সু হিজো”, “এল পেরো”, “ডোস ভিয়েজস”, “হম্ব্রেস লেয়েন্ডো”, “জুদিথ হলফার্নেস”, “ডস মুজেরেস ই উন হম্ব্রে”, “লা লেওসাদিয়া”, “ডুয়েলো এ গোরোটাজোস”, “ডোস ভিয়েজোস কমিয়েন্ড সোপা”, “প্রসেশন দেল সেন্ত অফিসিও”, “অ্যাকুইলারে”, “লা রমেরিয়া দিসান ইসিড্রো”, “অ্যাস্মডিয়া” ও “অ্যাত্রপস” এই ১৪টি অসামান্য সৃষ্টি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভাষ্যস্বরূপ আমার উপলব্ধিসঞ্জাত এই গুচ্ছকবিতার রচনা।)


❑ খিদে

বেঁচে থাকাই একমাত্র জীবনধর্ম। 

তাই, বিরুদ্ধে প্রকৃতি তবু যৌনপিপাসা নিয়ে আরো বেঁচে থাকাটুকু সুনিশ্চিত করা।

কিন্তু, যে পেট্রিডিসে অ্যাসিডের নামে লাখ লাখ অপত্যের মৃত্যু লেখা আছে,

তার জন্য কী রেখেছ - অসহ যন্ত্রণার 

তোমার এ সঞ্চয়ে স্থিতপ্রজ্ঞ অভিশপ্ত উত্তরাধিকারে?-

এইসব চিন্তা নিয়ে ক্লান্ত কোনো ঝুপড়ির ধারে,

ধুঁকে ওঠে সদ্যজাত সন্তানের পিতা, 

অনেক হিসেব কষে দেখেছে নিশ্চিত-

এখনই সময় নয়, 

দারিদ্র্যের যুদ্ধক্ষেত্রে আনকোড়া বোড়ে ছেড়ে বাণপ্রস্থে যাওয়ার,

এখনো অনেক দেনা শোধ করা বাকি - 

দরিদ্রবিরোধী এই সমাজের কাছে।

এ অপেক্ষা শেষ হবে কবে? তারিতে ডুবেছে পিতা,

তিন কন্যা এক পুত্র কেরোসিনে অভিষেক করে,

অসহায় পিতা আজ গৃহিণীর পাশে, কাবাবের সুস্বাদু পিন্ড সাজাবে…



❑ অথঃ সারমেয়কথা

রাষ্ট্র আমার কথা ভাবে- এই ভেবে এতকাল লেজ নেড়ে কুত্তার মতো 

প্রতিটি বাজেট শেষে বস্তি ভেঙেছি,

প্রতিবার এমার্জেন্সি লাগু হলে হেসে, দরজা বন্ধ করে সোফায় বসেছি।

শীততাপ নিয়ন্ত্রিত লাশঘরে ঘুরে,

এমনকি ধাপাতেও জায়গা হয়নি, এমন মৃতের স্তুপে শোপিস খুঁজেছি,

বিদ্রোহ বেআইনী ঘোষণার পরে বিরিয়ানি সহযোগে সেরেছি ডিনার,

তারপর একে একে বিরুদ্ধ মত যত দেওয়ালে সেজেছে মৃত হরিণের পাশে,

ফিরে এসে এসি ঘরে পরাধীন যোনির সম্ভোগ-

এসবই আমার জন্য- এমনটা রাষ্ট্র বলেছিল।

তারপর একদিন হঠাৎ সকালে ঘুম ভাঙে-

জেগে উঠি মৃতদেহস্তুপে,

একলা খুঁজছি পথ, একা এই নয়া অন্ধকারে

কোথায় আমার প্রভু, কোথায় শাসকশ্রেণী ক্লোস্ডডোর মিটে-

বুঝি আমাকে ছেড়েই আজ পরবর্তী বাজেটের আসর বসেছে!



❑ বুড়োর ভয়

জীবনের উদ্দেশ্য কী? - এই প্রশ্ন যতবারই জাগে,

অজ্ঞাতে মৃত্যু এসে কাঁধ চেপে ধরে।

শিক্ষার পূর্বস্বত্ব নেয়নি যে ভবিষ্যৎ, তার দিকে চেয়ে, কেঁপে ওঠে বুক,

ত্রাস জাগে মনে-

এত জ্ঞান এত পুঁথি এত অভিজ্ঞতা - এসব কি বৃথা যাবে!

মৃত্যু এসেছে পাশে,  বুড়ো ডেকে ওঠে-

দ্রুত জেগে ওঠো দেখো আকাশের কোণে 

তোমাদের অজ্ঞাতে প্রলয় জেগেছে



❑ স্বত্ববিধান

যাদের প্রশ্রয়ে এই জুয়ায় মেতেছি, তারাই একে একে সর্বস্ব লুটেছে,

আমি কপর্দকশূণ্য, পড়ি নিয়মাবলী-

যদি কোনো পথ খুঁজে পাই…

তারাও কানের কাছে ধর্মগ্রন্থ পড়ে, আর, আরো আরো মদ ঢালে আমার পেয়ালায়।

আমি চেপে ধরি যৌনাঙ্গ,

এটুকুও হেরে গেলে কী হবে আমার?



❑ রমণী

প্রেয়সী ছিলে না কোনোকালে, তাই বলে এইভাবে মৃত্যু রেখে যাবে?

বিশ্বাস জিনিসটার কোনো মূল্য দিই নি কখনো,

তাই, কঙ্কালস্তুপে আমি প্রাসাদ গড়েছি,

তাও তোমায় জানি না কেন সবকিছু দিয়েছি বিলিয়ে!

বিশ্বাসটুকুও তার ব্যতিক্রম নয়,

তবে জেনে রেখো- যে আঁধার পুঁতে দিয়ে গেলাম,

তাই নিয়ে ধর্ষকাম অপত্যেরা ধীরে ধীরে প্রাসাদ ভরাবে…



❑ ঠাট্টা

তোমরা সত্যকে অস্বীকার করে, এই যে তামাশা বেঁধেছ,

জানো কি তার পর্দা উঠে গেলে, নগ্ন নির্মম সেই নিয়তি- তোমাদেরই লেখা।

সেও ঠাট্টা করে তোমায় জানিয়ে যাবে হেসে-

মৈথুনশেষে এই অন্ধকারে তোমাদেরও প্রয়োজন ফুরোবে।



❑ কবরখানায় এসে বসো

যদিও শীতের রাতে তোমার ঠিকানাটুকু নিশ্চিত করিনি, তবু,

রক্ষিতা, এই কবরখানায় এসে বসো,

এখানে আমিও খুব একা, 

এখানে অর্থদম্ভ কফিন পেরিয়ে সান্ত্বনা দিতে আর পারে না আমায়,

তোমার পাওনাটুকু দিই নি, সে অভিযোগে এখানে নাহয় 

যতখুশি গালাগাল করে যেও রোজ,

তবু তুমি এসো,

কী নাম তোমার আমি জানিনি কখনো,

শরীরটুকুর সেই গন্ধে দিয়ে তামাকের ছাই

যতবার নামহীন করেছি তোমায়-

আজ সেই শোধ নিতে কবরখানার পাশে এসো,

যতবার আঘাত করেছি আমি, উন্মত্ত জন্তুর মতো, গুনে গুনে তত লাথি মেরে যেও কবরের গায়ে-

তবু, দোহাই তোমায়,

কবরখানায় এসে বোসো, 

এই অন্ধকারে আর একা হতে দিও না আমায়!



❑ মৌষলকাল

জনগণ খিদে বোঝে, তাই, আজ তুমুল ক্ষেপেছে।

হরতাল, অবরোধ, পিকেটিং শহরে-বন্দরে,

এসব সামাল দিতে মন্ত্রীরা নিয়েছে শপথ।

দুর্দিন দূরবীন ছাড়াই গিয়েছে দেখা- দারুণ সময়!

অন্দরমহলে রাজা পাঁয়চারি করে- কীভাবে পেরোবে এই মৌষলকাল?

একথা জানালে পরে, দিমাকের বাত্তি জ্বলে ওঠে-

পরদিন বাজেটের সমস্ত টাকায় বাড়িবাড়ি পৌঁছে যায় সোনার মুষল,

তার গায়ে নক্সা আঁকা দেশের মতোই-

একদম হুবহু; কেবল একটু করে তফাৎ রয়েছে-

কারো গায়ে ধর্ম আঁকা, কারো গায়ে জাতিবিদ্বেষ, কিম্বা জাতীয়তাবাদে চোবানো সে মুষলের গায়ে

মিথ্যে কিছু অহমিকা, ঐতরেয় লিপি।

রাজা তার দরবারে বসে, রিপোর্ট চাইলে পরে দেখা যায় শেষে-

ঘরে ঘরে মুষলের যুদ্ধ লেগে গেছে…


জনগণ খিদে বোঝে - এমনটা ভেবেছিল যারা, তারা আজ তুমুল ক্ষেপেছে,

ঘরে ঘরে মুষলের যুদ্ধ থামাতে গিয়ে, একে একে মুষলের আঘাতে নিহত।

তুচ্ছ পেটের খিদে, জনগণ সবকিছু ভোলে,

রাজা আর মন্ত্রীরা নিশ্চিন্তে মহাভোজ সারে, ঊদ্গার তোলে।



❑ চা-চক্র

ছোট থেকে বড় সন্ধ্যের এই সময়টায় টিভির সামনে এসে বসে, 

চা খায়, গল্প করে, খবর দেখে।

টিভিতে দেখায়- রাতে ধর্ষিতা মেয়ের মৃতদেহ ঘিরে, প্রমাণ লোপাট করে, পুলিশেরা আগুন লাগিয়েছে-

ছোটরাও আছে, এসব ওদের দেখার নয়!

চ্যানেল পাল্টায়।

স্টাইপেন্ড কম বলে, কিম্বা, আরো কোনো বেফালতু দাবিদাওয়া নিয়ে 

কলেজের বাইরে আজ ধর্ণায় বসেছে কারা?

ওরা বাজে ছেলে!

কলেজে পড়তে যাবে, শিখতে যাবে চাকরির বিষয়; ভুলভাল দিকে এত মন দেওয়া কেন?-

চ্যানেল পাল্টায়।

কৃষকের শ্রমিকের আত্মহত্যা- এইসবই পালানোর ছুতো,

দম থাকলে ওরাও একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হতো!

চ্যানেল ঘোরাও।

তৃষ্ণার্ত দলিতের মন্দির লাগোয়া কলে জল খাওয়া দেখে- সবাই একসাথে রে রে করে ওঠে,

ঠিক হয়েছে মরে গেছে, আপদ বিদায়, 

ছোটজাত!

অপবিত্র করে দিল মন্দির চত্বর-

চ্যানেল পাল্টায়।

জনসংখ্যায় চিন হারবে এবার, কী সুখ! কী সুখ!

এমন গৌরব দেশ দেখেছে কখনো?

সুসমাচার!

শিক্ষাহীন-কর্মহীন-খাদ্যহীন-মানুষেরা মিছিল চালায়- 

রাজধানী অব্দি যদি পৌঁছে গেল বুঝি ওই, 

হাঘরে-হাভাতে সব, যত দাও মেটেই না খাই;

আর এইসব বামপন্থী- আকাট আবাল- এদের প্রশ্রয়েই আজ দেশের এ হাল!

চ্যানেল পাল্টায়-

অযথা অন্যের বিপদ দেখে দাঁড়ানোটা জেনে রেখো- 

বুদ্ধিমানের কাজ নয়!




❑ শতপথ ব্রাহ্মণ

“ঈশ্বরের ইচ্ছাধীন সৃষ্টির সম্যকে- কেবল ব্রাহ্মণ একা শুদ্ধতম জেনো।

তোমাদের আনুগত্য, শ্রদ্ধাভক্তি নিয়ে একমনে আমাদের কথা মেনে চলো।”-

এমন ঘোষণাকালে নিরন্ন দলিতের হাহাকার জাগে, নির্যাতিতা নারীদের রুদ্ধ শীৎকারে

মহাকাশ পার করে দৈববাণী শোনা যায় ভোরে-

এদেশে ব্রাহ্মণই সব, তাই আজ কালের নিয়মে,

বিদ্রোহের শতপথ ব্রাহ্মণের ঘর দিয়ে যাবে।



❑ ডিটেনশন ক্যাম্প

রাশি রাশি পোকামাকড়ের মতো গুরুত্বহীন ওরা।

আমাদের ট্যাক্সের টাকা মেরে বেঁচে ছিল এতকাল ধরে।

রেশন যদি বা পেত, তাও তো কাগজ ঠিক নেই!

বলে নাকি বন্যায় ভেসে গেছে সব, কিম্বা বস্তি ভেঙে

যেইদিন গড়ে ওঠে প্রাইভেট মল, সেইসব ধুলো হয়ে মিশে গেছে-

মিথ্যুক সব!

বলে নাকি- ওরা কত শ্রম দিয়ে দেশটাকে আপন করেছে,

ওদের শ্রমেই নাকি আজ যতকিছু, 

ওদের ক'পয়সা ট্যাক্সের টাকা নাকি- আমাদের ঘরে আসে মাইনের মতো,

আস্পদ্দা দেখো!

পুরে দাও ওদের আমাদের পায়ে যদি নাই আসে ওরা,

পুরে দাও যদি ওরা নাগরিক অধিকার দাবি করে এসে, 

পুরে দাও ছিল যারা বিরোধী মিছিলে-

আর যারা আমাদের ভুল ধরেছিল...



❑ মৃত্যুতীর্থ

এই দেশ শিশুদের বাসযোগ্য কিনা- সেসব নিরীক্ষা করতে পথে নামে গবেষক এক,

যেসব নিষিদ্ধ ছিল, সেইসব পাঠ নিয়ে একে একে লিখে গেছে পাগলের মতো-

মুক্তির ইস্তেহার।

রাজপথে। রোজ ডেকে ডেকে বিলিয়েছে সেসব কবিতা,

ঘরে ঘরে ডেকে গেছে সুখনিদ্রাকালে…

সেসব জনশূণ্য মিছিলের খবর কেউই রাখে নি আর,


আজ শ্মশানের পথে, তার সাথে উঠে আসে কত কঙ্কাল।

এদেশ তীর্থে গেছে কতকাল হোলো,

সময় হয়েছে তাকে এ শ্মশানে ফিরিয়ে নেওয়ার।



❑ দৈববাণী

মুসোলিনির মৃতদেহ মাঝরাস্তায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল,

থুতু আর পাথরের আঘাতে আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে,

যারা রোজ ঘুম ভেঙে ওঠো, 

চেয়ে দেখো আকাশের কোণে 

"তোমারে বধিবে যে"- সে খবর নিয়ে আজ পাখীরা বাসায় ফিরছে।



❑ অন্ধকারের মেয়ে

অন্ধকারের মেয়ে, এইবার তুমি ফিরে এসো,

প্রলয়ের আগে শেষ চেতনার মতো, আমাদের ডেকে নাও সকালের পথে।

মৃতদেহ স্তুপ হয়ে প্রহর গুনছে, কত প্রণয়ীর চিতাভষ্মে অন্ধকার নামে,

তোমার চিৎকার শুনে বধির হয়েছে যারা, তাদের দোহাই

ফিরে এসো এইবারে বজ্রনির্ঘোষে।

তোমার আসার পথে- এতকাল এত কষ্টে কাঁটা তুলে তুলে,

বিদ্রোহী যারা রোজ ফুল পেতে গেছে,

তাদের দোহাই- আজ বিদ্যুতের মতো করে এই অন্ধকারে, তুমি ফিরে এসো!

অন্ধকারের মেয়ে, যারা কাল ভুল করে তোমার মৃত্যু লিখেছিল,

তাদের সন্তানদের ক্ষমা করো এবারের মতো,

অন্ধকারের মেয়ে, মুক্তির আলো নিয়ে এইবারে তুমি ফিরে এসো! 



চিত্রঋণ: ফ্রান্সিস্কো গোয়া



Comments

Popular posts from this blog

অন্ধেরা সার বেঁধে দাঁড়াও -১

ইস্তেহার